আমি যে অফিসে এখন চাকরি করছি সেখানে একটা ডে আউটের প্লান করা হচ্ছে। অফিসের সবাই একদিনের জন্য ঘুরে আসবে। স্বভাবতই সবাই খুব এক্সাইটেড, আমি নিজেও। কথায় কথায় আমাকে প্রশ্ন করা হল আমি বাচ্চা নিয়ে যাবো কিনা, আমার উত্তর ছিল- আরে নাহ্ বাচ্চা নিয়ে গেলে আমি নিজে মজা করতে পারবোনা।
যারা সামনে ছিলো রীতিমতো আতকে উঠেছে, একজন তো বলেই ফেললো, বাচ্চা ছাড়া জীবনে কি কিছু আছে আপা, নাহ্ আপনার কথাটা ভালো লাগলোনা।
আমাদের মাথায় কবে কখন কিভাবে যেন একটা বিষয় খুব সেট হয়ে গিয়েছে, বাচ্চা একবার হলেই জীবনে বাচ্চা ছাড়া আর কিছুই লাগবেনা, কিছুই বাচ্চা থেকে বড়ো দরকারি না, জীবন গোল্লায় যাক, বাচ্চাকে সময় দিতেই হবে। সময়, সুযোগ আর সাথে বাকি সব কিছুই হবে বাচ্চা কেন্দ্রিক। নিজের জীবন? এতদিন তো নিজের জীবন কাটিয়েছিই, এখন আবার কিসের নিজের জীবন।
আমি এই চিন্তার পক্ষপাতি না, প্রথম থেকেই না। আবার বাচ্চা জন্ম দিয়ে “কোনোভাবে তাকে বড়ো করা”র পক্ষপাতিও আমি না। আমি বাচ্চার জন্য করা কাজ আর নিজের জীবন উপভোগ করা এই দু বিষয়ে ভারসাম্যতা রাখার পক্ষপাতি, দুইটার মধ্যে সময় সময় প্রায়োরিটি দেয়ার পক্ষপাতি।
বিষয়টা আরেকটু গুছিয়ে বলি।
আমার যখন একটা প্রোমোশন হবার কথা ছিলো আমি সেই মাসেই জানতে পারি আমি গর্ভবতী, ফিটাস হামজা তখন প্রায় ৯ সপ্তাহের। আমার সেই প্রোমোশন এবং আমার প্রেগ্নেন্সি, দুইটাই আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, কিন্তু আমি সেই দুইটার মধ্যে প্রায়োরিটি দিয়েছি হামজাকে, তাই নিশ্চিন্তে চাকরী ছেড়ে হামজার ঠিক ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত হামজাকে পুরোটুকু সময় দিয়েছি। চাকরীর কথা চিন্তা করা বা খোঁজ করা কোনটাই ছিলো না।
আমার ক্যারিয়ারও যেহেতু আমার প্রায়োরিটি ছিলো, তাই ১৮ মাস থেকে হামজাকে বুঝিয়েছি, আম্মু কিন্তু বাইরে যাবো আবার সন্ধ্যায় চলে আসবো। হামজা বুঝেছে এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে মেনেও নিয়েছে। অবশ্য আমার জীবনে একজন মুসলমান মা হিসাবে, প্রথম দ্বায়িত্ব আমার সন্তানই তাই আমি যখন বাসায় থাকি, যতোটুকু সময়ই থাকি, শুধুই হামজার সাথেই থাকি। তাকে কোনোভাবেই এই অনুভূতি দেইনা যে মায়ের কাছে তার প্রায়োরিটি কম।
আবার আমি ঘুরতেও ভালোবাসি, ঐ দিকটাও কিন্তু আমার আরেকটা সত্ত্বা। আমি সবসময় এমন সুযোগ পাইনা যে হুটহাট কোথাও চলে যাবো, তাই যখন এই সুযোগ পাই, প্রায়োরিটি তখন আমি নিজে। আবার প্রতিদিন হামজার ঘুম থেকে উঠার আগের ১ ঘণ্টাও আমার নিজের। এই সময়ে আমি আয়েশ করে কফি খাই, কোলে থাকে আমার বিড়াল কিংবা একটা বই । এই একঘণ্টা শুধুই আমার। এটা আমার প্রতিদিনের সকাল।
আমার এই “আমি” সত্ত্বাকে হামজার জন্য হারাতে রাজিনা। রাজিনা এই কারনে যে, এটা আসলে সুস্থ কোন এটাচমেন্ট না। জীবন যদি শুধুই বাচ্চাকে ঘিরে চলতে থাকে একসময় বাচ্চারও যখন নিজের জীবন হবে তখন কষ্টটা কিন্তু শুধু মা আর বাচ্চা দুইজনেরই না, বাচ্চার জীবনে আসা অন্য মানুষদের জন্যেও। বেশিরভাগ পরবর্তী সম্পর্কগুলোর নষ্ট হবার পেছনে এই অসুস্থ এটাচমেন্টই মুলত দায়ী।
আমার পেরেন্টং চিন্তা ভাবনা এমনটা হবার কারন, আমি এমন অনেক মায়েদের দেখেছি বাচ্চার জন্য নিজের জীবন শেষ করে দিতে এবং ছোট কোন সমস্যার জন্যেই- “আমি তোর জন্য এতো কিছু করলাম আর তুই আমার সাথে এমন করিস” এই বুলিটা আওরাতে। এটা যে কতোটা টক্সিক হতে পারে সেটা বোঝা যায় যখন একটা বাচ্চা নিজের মতো করে একটু বাঁচতে চায়।
ডিয়ার রিডার পেরেন্টস্, নিজের বাচ্চাকে ভালোবাসা দেয়ার আগে একটু নিজেকেও ভালোবাসুন, মনে রাখবেন, আমাদের দায়িত্ব বাচ্চাকে একজন Functioning Adult হিসাবে বড়ো করা যেন সে নিজের মতো চলতে পারে, আমাদের ভালোবাসা দিয়ে তাদের পঙ্গু করে তোলা নয়। আমাদের জীবনের সবকিছুই যেন শুধুমাত্র বাচ্চা কেন্দ্রিক না হয়ে যায়।
ছবিতে আমি, হামজাকে ছাড়া ২ দিনের ছোট্ট একটা ট্যুর দিয়েছিলাম, টাঙ্গুয়ার হাওরে। জোছনা দেখতে গিয়েছিলাম দুই বান্ধবীকে নিয়ে।